শবে বরাত: বরকতময় একটি রাত
আরবী চন্দ্র বর্ষের অষ্টম মাস হল শাবান মাস। এ মাসের পনের তারিখ রাতটি শবে বরাত নামে পরিচিত একটি বরকতময় রাত। শব ফারসী শব্দ যার অর্থ রাত আর বরাত আরবী শব্দ যার অর্থ নাজাত, মুক্তি, পবিত্রতা। শবে বরাতে আল্লাহ অগনিত মানুষকে ক্ষমা করে দেন জাহান্নামীদেরও মুক্তি দেন বলে রাতটি শবে বরাত যা মুক্তির রাত বা সৌভাগ্যের রাত হিসেবে পরিচিত। মহানবী (সাঃ) অন্যান্য মাসের চেয়ে এই মাসেই বেশী নফল রোযা রাখতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রমযান ছাড়া অন্য সময় পূর্ণমাস রোযা রাখতে দেখি নাই এবং শাবান মাসের মত অধিক পরিমানে নফল রোযা অন্য কোন মাসে রাখতেও দেখি নাই। (বুখারী-মুসলিম,নাসায়ী) নাজাতের এই রাতে মানুষ যেন ইবাদাত-বন্দেগী করতে উদাসীন না থাকেন সে ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সতর্ক করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) বলেন: একদা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম হে আল্লাহর রাসুল! আমি তো আপনাকে শাবান মাসের মতো অন্য কোনো মাসে এতো অধিক রোযা রাখতে দেখি নাই? উত্তরে মহানবী (সাঃ) বলেন, এ মাসটির ব্যাপারে মানুষ বড়ই উদাসীন থাকে। অথচ এ মাসেই মানুষের আমল সমূহ আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হয়। আমি চাই আমার আমলগুলো এমন অবস্থায় পেশ করা হউক যখন আমি রোযাদার। (নাসায়ী, বায়হাকী) এই রাতের ইবাদাত করার জন্য মহানবী (সাঃ) এর অসংখ্য সহীহ হাদীস রয়েছে যাতে, এ রাতের বরকত ও ফযীলতের কথা বলা হয়েছে।
তন্মধ্যে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে তিনি বলেন, এক রাতে আমি মহানবী (সাঃ) কে শয্যা পাশে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম এবং তাঁকে জান্নাতুল বাঁকীতে পেলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন হে আয়েশা! তুমি কি এই আশঙ্কা করছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার উপর অবিচার করবেন? আমি বললাম হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) আমি ভেবেছিলাম আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গমন করেছেন। অতঃপর হুজুর (সাঃ) বললেন, ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বনু কালব গোত্রের পালিত ছাগলের পালের শরীরের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমদ) একটি বকরীর শরীরের অসংখ্য পশম থাকে যা গণনা করা প্রায় অসম্ভব। আর এক পাল বকরীর শরীরের পশমতো গণনা করা অসম্ভব। এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা এ রাতে এর চেয়ে আরো অধিক সংখ্যক গুনাহগার মানুষকে ক্ষমা করে থাকেন। তবে মুশরিক ও পরস্পর বিদ্বেষ পোষনকারীকে ক্ষমা করা হয় না এ ব্যাপারে হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহ তায়ালা শাবানের ১৫ তারিখ রাতে তার বান্দদের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং মুশরিক ও পরস্পর বিদ্বেষ পোষনকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে হিব্বান, আততারগীব) অপর একটি হাদীসে হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রহঃ) হতে বর্ণিত লাইলাতুল কদরের পর শাবানের ১৫ তারিখ রাতের চেয়ে উত্তম কোনো রাত নাই। এই রাতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং তার সকল মুমিন বান্দাদের ক্ষমা করে দেন।
মুশরিক, পরশ্রীকাতর এবং আতœীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ছাড়া। (মাসাবাতা বিস সুনান) এই বরকতময় রাতে দুআ কবুল হয় এ প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রসিদ্ধ হাদীস রয়েছে। হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পাঁচটি রাত জাগ্রত খেকে ইবাদাত করে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। যিলহাজ মাসের আট তারিখ,আরাফাতের রাত, যিলহাজ মাসের দশ তারিখ তথা কুরবানীর ঈদের রাত,ঈদুল ফিতরের রাত, শাবান মাসের মধ্য রাত তথা বরাতের রাত। (আততারগীব ওয়াত তারহীব, ইলাউস সুনান) হযরত আব্দুলাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: পাঁচটি রাত এমন রয়েছে, যাতে বান্দার কোনো দু‘আ ফেরত দেয়া হয় না। জুমার রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শাবানের মধ্য রাত, দুই ঈদের দুই রাত। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক) এই রাতে বেশী করে তাওবা ইস্তিগফার ও মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। হযরত ওসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই বলে ডাকতে থাকেন, তোমাদের মাঝে আছে কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো? আছে কি তোমাদের মাঝে কিছু চাইবার মতো কেউ, আমি তার সকল চাহিদা পুরণ করে দেবো?
অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এভাবে সকল প্রার্থনাকারীর সকল প্রকার বৈধ মনোবাসনা পূর্ণ করে দেয়া হয়। কিন্তু ব্যভিচারিণী এবং মুশরিকদের প্রার্থনা কবুল করা হয় না। (আদ্দুররুল মানসুর) শাবানের পনেরতম রাতে ইবাদাত করার এবং দিনে নফল রোযা রাখার নির্দেশ রয়েছে। হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন শাবানের পনেরতম রাত তোমাদের সামনে এসে যায় তখন তোমরা সে রাতে নামায পড় এবং পরবর্তী দিনটিতে রোযা রাখ। কারণ সেদিন সুর্যাস্তের পর আল্লাহ পাক প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বান্দাদের ডেকে বলতে থাকেন আছো কি কোন ক্ষমা প্রার্থী যাকে আমি ক্ষমা করে দেবো? আছ কি কোনো রিযিক প্রার্থী যাকে আমি রিযিকের ব্যবস্থা করে দেবো? আছো কি কোনো বিপদগ্রস্ত যাকে আমি বিপদ মুক্ত করে দেবো? এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত বলতেই থাকেন, আছো কি কেউ অমুক বস্তুর প্রার্থী? আছো কি কেউ অমুক বস্তুরপ্রার্থী? আমি যার সকল মনোবাসনা পূর্ণ করে দেবো। (ইবনেমাযাহ) তাই সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণ এ রাতে জাগ্রত থেকে বিভিন্ন প্রকার মাসনুন আমলে লিপ্ত থাকতেন। যা বিভিন্ন প্রকার নির্ভরযোগ্য বর্ণনা দ্বারা সুপ্রমানিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। শবে বরাতের আমল সম্পর্কে মাযহাব চতুষ্টয়ের ইমামগণও সুন্নাত কেউ মুস্তাহাব বলেছেন।
এ রাতের মহত্ব ও ফযীলতের কারণে ইসলামের সোনালী যুগ থেকেই মানুষ এ রাতের ইবাদাতের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করে আসছেন। এ বরকতময় রাতে বোমা, পটকা ফুটানো, আতশবাজী, মাইকে কুরআন তিলাওয়াত করা নাজায়েয, এতে অসুস্থ ব্যক্তি, রোগীর কষ্ট হয়, ইবাদাতে বিঘœতা সৃষ্টি হয়। চাঁদা উঠিয়ে মসজিদে গরু খাসি জবাই করে বিরিয়ানী বা শিরনি পাকিয়ে মুসল্লিদের মাঝে বিতরণ করা হয়। গ্রামের মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করার কারণে শবে বরাতের রাতে তারা হালুয়া-রুটি, ফিরনী নিয়ে নির্দিষ্ট বাড়িতে বা স্থানে জামায়েত হয় তা বিতরণের জন্য এতে রাতের অনেক সময় অনর্থক নষ্ট হয়। ফলে শবে বরাতের আসল উদেশ্যই ব্যহত হয়। মসজিদ আলোক সজ্জা করা এটি বিধর্মী এবং হিন্দুদের দেওয়ালী উৎসবের সাথে সাদৃশ্য হওয়ার কারইে নাজায়েয। মসজিদে হৈচৈ করা, কবরস্থানে মেলার আয়োজন করা, অযথা ঘুরা ফেরা করা, বিভিন্ন প্রকার রং তামাশা দেখে এ মূল্যবান সময় নষ্ঠ করা, তাছাড়া সারা বছরে সমজিদে যে আগরবাতী ও মোমবাতী জমা হয় শবে বরাতে তা সারা রাত মসজিদে জ্বালিয়ে নি:শেষ করা হয়। এসবই গুনাহর কাজ। প্রত্যেক মুসলিমের তা পরিহার করা উচিত। উপরোক্ত হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, এই সম্মানিত ও মহিমান্বিত বরকতময় এ রাতে মসজিদে বা বাসা- বাড়ীতে বেশী করে ইবাদাত বন্দেগী, নফল সালাত আদায়,কবর যিয়ারত, মৃত আত্মীয়-স্বজনের জন্যে দু‘আ করা, দান-সাদকা, খানা পাক করে গরীব মিসকীনদের মাঝে বিতরণ করা, কুরআন তিলাওয়াত, বিভিন্ন দু‘আ- দরুদ, তাসবীহ- তাহলীল পাঠ করে অতিবাহিত করা প্রত্যেক মুসলিম এর চেষ্টা করা উচিত। আল্লাহতায়ালা বিশ্ব মুসলিম উম্মাহকে লাইলাতুল বরাআতের ফযীলত ও তাৎপর্য অনুধাবন করে রাতে আল্লাহর ইবাদাত ও রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এঁর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)